অলৌকিক ।
১৯৯৫ সাল । সিমেন্স এ চাকরি সুত্রে পাটনা শহরের জনবহুল কংকরবাগ এলাকায় অনেক কাঠখর পুড়িয়ে সিংজি র বাড়ির দোতলায় গ্যারেজ বারান্দা সহ একটা ঘর, বাথরুম ও রান্নাঘর সমেত ভাড়া পেয়েছি । পেশায় উকিল সিংজি কে অনেক হাতেপায়ে ধরার পরে ঘর টা ভাড়া পেয়েছিলাম কারণ ব্যাচেলর দের সচরাচর কেউ ভাড়া দিতে চায় না । যাই হোক , রাত্রিবেলা রান্নাবান্না করে অনেক রাত অবধি আমার ঘরের লাগোয়া গ্যারেজ বারান্দায় বসে একটু রাতের হাওয়া খেতাম । চাঁদনী রাতে খোলা আকাশের নিচে গ্যারেজ বারান্দায় আরামকেদারায় বসে চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পরতাম, খেয়াল থাকত না । সিংজি র বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে একটা দোতলা বাড়ি ছিল, যে বাড়িটায় আমি কখনো কোনো লোক দেখিনি বা কখনো কোনো লোকের আনাগোনা দেখিনি । বাড়ির জানালা, দরজাও বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকত কেবল রাতের বেলা টুকু ছাড়া কারণ অনেক সময় রাত্রিবেলায় বাড়ির জানালায় বা কখনো কখনো বারান্দায় এক যুবতী কে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি । মাসখানেক ঠিক রাত বারোটা নাগাদ রোজ দেখতাম যে ওই যুবতী এক দৃষ্টিতে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে । প্রথম প্রথম ব্যাপারটায় অস্বস্তি লাগলেও পরের দিকে একটা অদ্ভূত অভ্যাসে পরিনত হয়ে গিয়েছিল । ব্যাচেলর হবার সুবাদে কৌতুহলবশত কারণে কিনা জানিনা , কিন্তু প্রতিদিন রাত বারোটা নাগাদ ওই যুবতী কে খুজতাম বারান্দায়, এবং আশ্চর্য্যজনক ভাবে কখন, কিভাবে এবং কোন ফাকে তিনি উদয় হতেন, আমি সত্যি জানিনা, কিন্তু ওনাকে দেখে বেশ মজা লাগত এবং ব্যাপারটা কিছুটা আমার সেই সময়ের ফুটন্ত যৌবনের প্রভাবে রোমাঞ্চকর লাগত, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।
যাই হোক, কৌতুহল চাপতে না পেরে একদিন সিংজির ছেলে কে, যে কিনা আমার বয়েসী হবে, তাকে জিগ্গেস করেই ফেললাম যে ওই যুবতী কে ??? আমার প্রশ্ন শুনে সিংজি র ছেলে চোখ বড় বড় করে রীতিমত ভিমরি খাওয়ার জোগার । সিংজির ছেলেকে ওই যুবতীর বর্ণনা দেওয়ার পরে, সিংজির ছেলের বারবার একটাই প্রশ্ন ছিল যে আমি ঠিক দেখেছি কিনা । কারণ আমার বর্ণনা অনুযায়ী যে যুবতীর কথা বলছি, সেই যুবতী বাবা, মায়ের একমাত্র মেয়ে । হঠাত করে বাবা এবং মা মারা যাওয়ার পরে ওই যুবতী একাকিত্বে ভুগতে শুরু করে এবং একদিন পাড়ার লোকেরা সিলিং ফ্যান থেকে তার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে । তারপর থেকে ওই বাড়িটি তে কেউ আর কখনো বসবাস করেনি । সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পরে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল । এরপরে বেশ কিছুদিন রাত দশটা হলেই শুয়ে পরতাম এবং দরজা বন্ধ করে শুতাম যাতে সে দিকে আর নজর না যায় । এর পরে সাহস করে ঘরের ভেতর থেকে চাদরের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওনাকে আর কখনো দেখা যায় নি । আস্তে আস্তে আমার মনের ভেতর থেকে ভীতি টা কাটতে শুরু করেছিল | ধীরে ধীরে আবার ওই বারান্দায় বসা আরম্ভ করলাম এবং মা বিপত্তারিনির লকেট ধরে বসে থাকতাম । সস্তির ব্যাপার যে ওই যুবতীকে আর কখনো দেখা যায় নি । নিছকই আমার চোখের ভুল বা মনের ভ্রম হিসেবে যখন আমি নিশ্চিত হতে শুরু করেছি, তখন ই বাধ সাধলো এক ঝড় বৃষ্টির রাত । বাজ পড়ার কর্করানি আওআজ এবং ঘন ঘন বিদ্যুতের ঝলকানির থেকে বাঁচতে মাঝ রাতে ঘুম থেকে উঠে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে গিয়েই চোখ পরে গেল উল্টোদিকের বারান্দার দিকে | বিদ্যুতের ঝলকানি তে পরিষ্কার দেখতে পেলাম সেই যুবতী, মাথাটা একটা সাদা রঙের ওরনা দিয়ে ঢেকে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । কোনরকমে দরজা বন্ধ করে ঘরের আলো জালিয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে সারা রাত জেগে বসে রইলাম । বাইরে তখন চলছে প্রচন্ড ঝড় আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি ।
পরেরদিন সকাল হতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম নতুন বাড়ির খোঁজে | কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাইনি আর তাই পরের পাঁচ বছর আমাকে ওই বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল । কিন্তু অবাক কান্ড হলো এই যে এর পরে আর কোনদিন ওই যুবতী কে একমুহুর্তের জন্যও আর কখনো দেখতে পাইনি । তার এই হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা আমাকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছিল যে পাগলের মতন মাঝ রাতে বারান্দার দরজা খুলে তাকে খুজেছি উল্টো দিকের বারান্দায় ভয়ডরহীন ভাবে | কিন্তু আর কখনো তাকে দেখা যায় নি ।
তারপরে কলকাতায় বদলি হবার সময় যখন সিংজি কে সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে মালপত্র নিয়ে বেরোচ্ছি, একটা আশ্চর্য্য জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম । ওই উল্টোদিকের বাড়ির নিচের তলার জানালাটা খোলা, যা কিনা গত পাঁচ বছরে একবারের জন্যও কখনো খোলা দেখিনি । কেন জানি না , ওই যুবতীর আকুল নয়নে তাকিয়ে থাকাটা মনে পড়তেই মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল | ট্রেন ধরার তাড়ায় অটোয় চেপে চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছিলাম ওই রহস্যময় বাড়িটা এবং ওই রহস্যময়ীর থেকে ।
আজ এত বছর পরেও ঘুমের মধ্যে চোখ খুললেই মনে পরে যায় ওই যুবতীকে, যেন করুন চোখে আমাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে । কি বলব এই গোটা ঘটনাটাকে ???? অলৌকিক নাকি ভৌতিক নাকি নিছক মনের ভুল ???? জানিনা । শুধু এইটুকু বলতে পারি যে আমার ওই পাঁচ বছরের একাকিত্বের একমাত্র সঙ্গী ছিল ওই রহস্যময়ী নারী ।
Comments
Post a Comment