বানজারা হিলস এর ভৌতিক গেস্ট হাউস |
২০১০ সাল । আমাদের কোম্পানি র কর্ণধারের নির্দেশে দু বছরের জন্য আমাকে হায়দ্রাবাদ যেতে হয়েছিল একটি ম্যানেজমেন্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করার জন্যে । কর্মসূত্রে হায়দেরাবাদ বহুবার গেছি । এমনিতেই অত্যন্ত প্রিয় শহর হায়দেরাবাদ । তার ওপরে হায়দেরাবাদ এর অভিজাত এলাকা বানজারা হিলস এর সিটি সেন্টার এর উল্টোদিকের রাস্তা দিয়ে একটু ভেতরে ঢুকে এক বহুতল এর ১০ তলায় কোম্পানি র নতুন গেস্ট হাউস এ আমার থাকার বন্দ্যবস্ত হবার পরে যেন হাতের কাছে চাঁদ পেয়েছিলাম । গেস্ট হাউস তো নয়, একটি তিন কামরার প্রায় ১৪০০ স্কোয়ার ফিট এর বিশালাকার ফ্ল্যাট । বারান্দায় দাঁড়ালে হোটেল তাজ কৃষ্ণা র সুইমিং পুল টা পরিষ্কার দেখা যেত । তখনও প্রজেক্ট এর অন্যান্য লোকেরা যোগদান করেনি । তাই অতবড় ফ্ল্যাটে একা একা কয়েকটা দিন রাজার জামাই ফুচকাওয়ালা হয়ে বেশ সুখেই ছিলাম । কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো, সেই সুখ আমার মাথায় উঠলো । সুখ পরিনত হলো দুস্বপ্নে । আসুন বলি সেই কাহিনী ।
সপ্তাহ খানেকের মাথায় অনুভব করলাম যে প্রতিদিন সন্ধেবেলায় খুব অদ্ভুত ভাবে সারা ঘরে আগরবাতির গন্ধ বিরাজ করে । সেই গন্ধের উৎপত্তি খুঁজতে পাশের ফ্ল্যাটে খবর নিতে গিয়ে জানলাম, আমাদের ওই ফ্লোর এ আপাতত কোনো বাসিন্দা নেই এবং অতবড় এপার্টমেন্টে মাত্র ৮ টি পরিবার থাকে । ফ্ল্যাট এর বেশিরভাগ মালিকগণ বিদেশে থাকেন । তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওই ধুপের গন্ধের উৎস খুঁজে বার করতে পারিনি । তাই বিরক্ত হয়েই মাথা ঘামানো বন্ধ করেছিলাম এই ব্যাপার নিয়ে ।
হুঁশ ফিরল একদিন গভীর রাতে । মনে হলো পাশের ঘরে কেউ সমানে একটা কাঠের বা প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে ঠুক ঠুক করে আওয়াজ করছে । এমনিতে আমি খুব ভিতু প্রকৃতির । রাতে ঘুমোনোর আগে অত বড় ফ্ল্যাট এর প্রতিটি ঘরের এবং বারান্দার আলো জ্বালিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুতে যেতাম । কিন্তু মাঝরাতে প্রতিদিন ওই আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত এবং ঘুম থেকে উঠে দুরু দুরু বুক নিয়ে পাশের ঘরে যেতাম । আমি যেই ঘরে ঘুমোতাম, সেই ঘর থেকে বেরোলেই আর আওয়াজ পেতাম না । আবার ঘরে ঢুকলেই সেই আওয়াজ শুরু হত । এই ভাবে দিনকয়েক কেটে গেল । আমিও ধুপের গন্ধের মতই ওই আওয়াজ এ অভ্যস্ত হয়ে পরলাম ।
যত দিন যেতে লাগলো, ঘটনা প্রবাহ তত ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে লাগলো । একদিন মাঝ রাতে ওই আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখি বারান্দার এবং পাশের ঘরের আলো গুলো সব নেভানো । পরিষ্কার মনে আছে যে আমি রোজকার মতই আলো জ্বালিয়ে শুয়েছিলাম । তবে আলো নেভালো কে ??? সমস্ত আলো আবার জ্বালালাম । যথাযথ ভাবে আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে । খুব বিরক্ত এবং কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে আবার আমার ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি ঘুমোতে যাব বলে, এমন সময়ে লোড শেডিং হয়ে গেল । এবং আমার চারপাশের থেকে সেই অদ্ভুত ঠুক ঠুক করে আওয়াজ শুরু হলো । আমার মনে হলো কেউ যেন লাঠি নিয়ে ঠুক করে আমার চারপাশে ঘুরে ঘুরে আওয়াজ করছে । এবং আমি অন্ধকারে পায়ের শব্দ এবং হাঁটাচলার শব্দ পেয়েছি যা জানান দেয় যে আমি ছাড়াও ওই ফ্ল্যাট এ অন্য কেউ আছে । ভয়ে আমার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গিয়েছিল । গোঙানির আওআজ বের হতে যাবে গলা দিয়ে, এমন সময় আলো চলে এলো । ততক্ষণে ক্রমাগত হতে থাকা আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে । তাও মনে আছে, মিনিট দশেক খুব থরথর করে কেঁপে ছিলাম । সারা রাত বসে ছিলাম সোফা তে । সেদিন আর রাতে ঘুম আসেনি ।
এরপরে কয়েকদিন তিরুপতি এবং বিজয়ওয়ারা তে যেতে হয়েছিল কাজের সুত্রে । কয়েকটা রাত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম হোটেলে । দিন দশেক বাদে গেস্ট হাউস এ ফিরে এসে যে ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম, তা মনে করলে আজও আমার গা ভয়ে শিউরে ওঠে । মাঝরাতে মূত্রত্যাগ করতে বাথরুম এ গিয়েছিলাম । পরিষ্কার ঘাড়ের ওপরে কারোর নিশ্বাস পড়ল বলে মনে হলো । আমার তখন ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে । কোনরকমে বাথরুম থেকে হনহন করে শোবার ঘরের দিকে হাঁটা লাগলাম । দরজায় ভালো করে ছিটকিনি দিয়ে অনেক রাত অবধি জেগেছিলাম । সেদিন কিন্তু আর ঠুক ঠুক করে আওয়াজ পাইনি । কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, খেয়াল নেই । ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । দেখলাম, বসার ঘরের সোফা গুলো কেউ এদিক ওদিক করে সরিয়ে রেখে দিয়েছে । সেই মুহুর্তে নিশ্চিন্ত হলাম ঘরে অশরীরীর উপস্থিতি সম্বন্ধে ।
পরদিন সকালে গেলাম আমার বন্ধু সন্দীপ পান্ডে র কাছে । সব খুলে বললাম ওকে । সন্দীপ বলল ও কয়েকদিন আমার সাথে থাকবে । ঠিক হলো যে একটা ঘরে সন্দীপ শোবে আর আরেকটা ঘরে আমি । রাতে আমরা ঠিক করলাম যে দুজনেই ঘরের দরজা খোলা রেখে দেবো । এবং ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দেবো । কেউ ভয় পেলে চিৎকার করে ডাকলেই আরেকজন সারা দেবো তার ডাকে । সন্দীপের উপস্থিতিতে নিশ্চিন্তে সেই রাতে নাক ডেকে ঘুমিয়েছিলাম । পরের দিন সকালে চমকে গেলাম সন্দীপ এর প্রশ্ন শুনে । সন্দীপ সকালে দেখা হতেই আমাকে প্রশ্ন করে উঠলো যে আমার পেট খারাপ হয়েছে কিনা । কারণ রাতে আমি নাকি বহুবার বাথরুমে গেছি এবং ফ্ল্যাশ এর আওয়াজে নাকি সন্দীপের ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছিল বারে বারে । সন্দীপ প্রচন্ড ভয় পেল যখন শুনলো যে আমি বাথরুম এ একবারও যাইনি । তাহলে বাথরুম এ কে গিয়েছিল ???
পরেরদিন আমি আর সন্দীপ একসাথে শুয়েছিলাম । জানতাম না যে ওই গেস্ট হাউস এ ওটাই আমাদের দুজনের শেষ রাত | খাওয়াদাওয়া করে ঘরের আলো নিভিয়ে আমরা দুজনে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম । সন্দীপ এর কথা অনুযায়ী সারারাত আলো জ্বালানোয় হয়ত অশরীরীর জীবনধারায় আমরা ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলাম আর তাই হয়ত বারে বারে আদৌ যদি কোনো অশরীরী থেকে থাকে ঘরের ভেতরে, সে তার উপস্থিতির কথা আমাদের জানান দিচ্ছিল । যাই হোক, তখন রাত একটা কি দেড়টা হবে, হঠাত সেই অদ্ভুত ঠুক ঠুক আওয়াজে আমাদের দুজনের ই ঘুম ভেঙ্গে গেল । সন্দীপ আমাকে ইশারায় বলল না উঠতে । আমরা দুজনেই চাদর এর ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম বসার ঘরে । তারপরে যা দেখলাম, সেই দৃশ্য আজ ও ঘুমের মাঝে আমাকে তাড়া করে বেড়ায় । এই অভিশাপের হাত থেকে হয়ত আর কোনদিন মুক্তি পাবো না । বসার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরের আলো যেটুকু এসে পরেছিল ঘরের ভেতরে , সেই আলোয় স্পষ্ট দেখলাম লম্বা, চুলখোলা এক মহিলার ছায়ামূর্তি । হাতে একটা লাঠি । খুব বিব্রত ভাবে ছায়ামুর্তিটি পায়চারী করছে বসার ঘরে এবং সম্ভবত তার হাতের লাঠি দিয়ে মেঝেতে ঠুক ঠুক করে আওআজ করছে । কিছুক্ষণ বাদে স্পষ্ট দেখলাম যে ছায়ামুর্তিটি ঘরের সোফায় বসে পড়ল । আমার ততক্ষণে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে । সন্দীপ থরথর করে বিছানায় শুয়ে কাঁপছে । অতর্কিতে দেখলাম ছায়ামুর্তিটি খুব দ্রুত গতিতে আমাদের ঘরের দিকে এগিয়ে এলো । তারপরে দড়াম করে বিশাল আওয়াজে ঘরের দরজা টা বন্ধ করে দিল ।
আমাদের দুজনের জ্ঞান ফিরেছিল পরেরদিন সকাল বেলায় । অফিসের বস কে সব খুলে বললাম । খুব অবিশ্বাসের সাথে তারা আমাকে বলল কোনো হোটেলে স্থানান্তরিত হতে যতদিন না নতুন গেস্ট হাউসের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে ।
এরপরে কয়েকটা দিন মহানন্দে কেটে ছিল । আমি চলে গিয়েছিলাম মাধাপুরের কাছে একটা হোটেলে । প্রায়শই রাত ১০ টার শো তে সিনেমা দেখতে যেতাম । সিনেমা ভাঙ্গার পরে রাত একটায় হোটেলে ফিরতাম । ঘুমিয়ে পরতাম । পরেরদিন সকালে অফিস ।
শুধু একদিন একটা বিপত্তি ঘটেছিল । সিনেমা ভাঙ্গার পরে একদিন রাতে অটোওয়ালা শর্ট কাট রাস্তায় যেতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলল । অনেক রাত অবধি বানজারা হিলস এর নির্জন উঁচু নিচু রাস্তায় অটো ঘুরপাক খাচ্ছিল রাস্তার সন্ধানে । আমি বিরক্ত হয়ে গালাগালি করছিলাম অটো ওয়ালা কে । ততক্ষণে বানজারা হিলস এর ভেতর দিয়ে আমরা পৌছে গেছি হায়দেরাবাদ এর বানজারা হিলস আর মাধাপুর এর রাস্তার মাঝে একটা বিশালাকার নির্জন ভাগাড়ে । সেখানে যত অটো এগোচ্ছিল, শুধু চারিদিকে অন্ধকার আর মাটির রাস্তায় অটোর চাকা বসে যাচ্ছিল । অনেক কষ্টে একটা ভাঙ্গা মন্দিরের সামনে গিয়ে দুজনে এক সাধু বাবার শরণাপন্ন হলাম । সাধুবাবা আমাদের পথ দেখিয়ে দিল । তারপরে অটো তীব্র গতিতে চলতে শুরু করলো । অটো ওয়ালার কথা অনুযায়ী জায়গাটা আদৌ ভালো নয় এবং ওই সব জায়াগায় দুষ্কৃতকারীরা খুন করে লাশ ফেলে রেখে চলে যায় । প্রায় এক ঘন্টার চেষ্টায় অটো কোনরকমে আবার পাকা রাস্তার হদিস পেল । তীব্র গতিতে যাবার সময়ে অটোর সামনের কাঁচ দিয়ে একটা দৃশ্য দেখে ভয়ে আমার গা হাত পা কাঠ হয়ে গিয়েছিল । পরিষ্কার দেখলাম, একজন খোলা চুলে লম্বা মহিলা হাতে একটা লাঠি নিয়ে রাস্তার ধারে দাড়িয়ে লাঠি বারে বারে রাস্তায় ঠুকছে এবং অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাদের অটো র দিকে তাকিয়ে আছে । অথচ পাশ কাটানোর সময় আর ওই মহিলা কে দেখতে পাই নি ।
তবে কি ..... ??? জানিনা । ওই মহিলাকেও আর কোনদিন দেখিনি । আস্তে আস্তে ওই ঘটনা ভুলে গিয়েছিলাম ।
এরপরে ওই ঘটনার পরে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । হঠাত একদিন সন্দীপ এর ফোন পেলাম । শুনলাম, ওই গেস্ট হাউস এ স্টাফ এ দের জন্য বিহার এর দ্বারভাঙ্গা থেকে আনা একজন পরিচারক ওই গেস্ট হাউস এর ১০ তলা থেকে লাফিয়ে আত্বহত্যা করেছে । খবরের আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ গুম মেরে গিয়েছিলাম ।
ওই সংস্থাটি ছেড়ে দিয়েছি বহুদিন হলো । অন্য সংস্থার হয়েও বহুবার হায়দ্রাবাদ গেছি । কিন্তু ভুল করেও ওই গেস্ট হাউস এর রাস্তায় আর কোনোদিন পা মাড়াইনি ।
আর আজও হোটেলে বা আমার সিকিম এর বাড়িতে সারা রাত সমস্ত আলো জ্বালিয়ে শুই | যাতে করে আদৌ কোনো অশরীরীর উপস্থিতি থাকলে যেন চাক্ষুষ তাকে আর দর্শন করতে না হয় |
Comments
Post a Comment